অসম্ভবঃ আট

জনের কথায় রাজী না হয়ে আসলে তার আর কোনো উপায় ছিল না। তাই অবশেষে সে বেলকে গ্রামে রেখে এল। যে গ্রামে সে আর কখনো ফিরে যেতে চায়নি সেখানেই তাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হল। তবে গ্রামে গিয়ে সে চাচার বাড়ী থেকেই বের হয়নি। তার চাচারা বেজায় ভালো মানুষ, গ্রামের সহজ সরল মানুষ বলতে যা বোঝায় আর কি! না হলে জনের কথায় তারা এত সহজে রাজী হয়! জনের নাতি বেল খুবই নিরব প্রকৃতির ছেলে। এ বয়সে এমন স্বভাবের ছেলে তেমন একটা দেখা যায় না। ফ্রেডের সাথে গ্রামে গিয়ে সে আরো নিশ্চুপ হয়ে গেছে। চাচার বাড়ীতে ফ্রেড আগে যে রুমে থাকত সেখানেই বেলকে থাকার জায়গা দেয়া হয়েছে। মাত্র ৫ বছরের একটা ছেলে একা একটা ঘরে কীভাবে থাকবে সেটা নিয়ে অবশ্য চাচাদের মাঝে বেশ পরামর্শ চলেছে। কিন্তু বেলের স্বভাব ও আচরণ দেখে তারা বুঝল, এ ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।
ভার্সিটিতে ফিরে এসে ফ্রেড যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। তাই তো সে জানালা দিয়ে বাইরের তুষার ঢাকা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকার ভান করে জীবনের সুখস্মৃতিগুলো স্মরণ করছিল।
জীবনের সুখস্মৃতিগুলো যেন কেমন, এদের স্মরণ করলে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ভাবের উদয় ঘটে, জীবনের দৃশ্যপট যেন মুহূর্তেই বদলে যায়। তবে দুর্ভাগ্যই বলা চলে, এই ভাব বেশীক্ষণের জন্য স্থায়ী হয় না। কেন স্থায়ী হয় না - তা একটা বড় প্রশ্ন বটে। সম্ভবতঃ জীবনের কঠিন বাস্তবতা এই ভাবকে তার প্রতি তাচ্ছিল্য মনে করে দূরে সরিয়ে দেয়, অথবা কোনো অলীক কারণও থাকতে পারে যা হয়তো মানবজাতির কাছে এখনো পরিষ্কার নয়। সুখস্মৃতিগুলোকে স্মরণ করতে করতে ফ্রেড যে কখন ভাবনার রাজ্যে চলে গিয়েছিল বুঝতে পারল না।
ফ্রেড তার দৃষ্টি জানালা থেকে সরিয়ে এবার তার রুমে নিবদ্ধ করল। দেখল, ড্যান তার দিকে চেয়ে আছে। সম্ভবতঃ সে গভীরভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করছিল। তার দিকে তাকাতেই সে জিজ্ঞেস করল, 'কি ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে?'
- বাসায় ভাল লাগছিল না।
- কেন? বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?
- না, এমনিতেই ভালো লাগছিল না।
ফ্রেডের মুখের দিকে তাকিয়ে ড্যান আর কিছু বলল না।
ফ্রেড উঠে দাঁড়াল। এরপর জ্যাকেটটা হাতে নিতে নিতে ড্যানকে লক্ষ করে বলল, 'আমার এখন একটা ক্লাস আছে। পরে কথা হবে।'
কথা শেষ করে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।


জন তার অফিসের চেয়ারে বসে ভাবছিল তার জীবনের অতীত, বর্তমান ও সম্ভাব্য ভবিষ্যতের কথা, এক দেশ ও এক জাতিকে টিকিয়ে রাখতে তার পরিবারের নিঃস্বার্থ কুরবানীর কথা। কিন্তু তার চোখ সীমাহীন ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারছিল না। অবশেষে সে নিজেকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করল এটা ভেবে যে, জনগণের সাথে একটা পরিবার কি করে পারবে? সবাই তো তথাকথিত স্বাধীনতা চাচ্ছিল। কি করে তাদেরকে স্বাধীনতা অর্জন থেকে বিরত রাখা যাবে? কি করে তাদেরকে একথা বুঝানো যাবে যে, যে স্বাধীনতার জন্য তারা আন্দোলন করছে তা আসলে আরেক পরাধীনতার দরজা মাত্র? সুখ জিনিসটা মানুষ এত চায় অথচ যখন তা মানুষের কাছে ধরা দেয় তখন মানুষ তাকে সুখ বলে কেন যে চিনতে পারে না - তা জনের মাথায় আসে না। হতে পারে মানুষ আসলে মন থেকে সুখ চায় না অথবা এও হতে পারে যে, সুখ আসলে নিছক কল্পনা মাত্র।
জীবনের অনেকটা সময় জন পার করে এসেছে কেবল স্বপ্ন দেখে; তখন আবশ্য সে এতকিছু ভাবেনি। তখনো তো সে একজন নব্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিল মাত্র। আর এখন সে একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। এখন সবাই তাকে সম্মান-শ্রদ্ধা করে। সে ভাবে, তার মনের কথাগুলো যদি মানুষ জানত বা বুঝত তাহলে কতকিছুই না হতে পারত। একটা দেশের প্রধান হয়েও নিজের অপারগতার কাছে সে কত অসহায়! কিন্তু একথা সে ছাড়া আর কেউ জানতেও পারে না কিংবা পারে না বুঝতেও।
মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রজাতির, ভাবে জন। দুই দিনের পরিচয়েই তারা মনে করে তারা একে অপরকে চিনে ফেলেছে, অথচ একটা সময় আসে যখন বুঝতে পারে তাদের এ ধারণা সত্যি ছিল না। তারা নিজেদেরকে আবার নতুন করে চিনতে শেখে কিন্তু আবারো একই ভুল করে। এত এত যুগ পার হলো কিন্তু মানুষের এই প্রাচীন অভ্যাসের কোনো পরিবর্তন এল না।
জনের পিএস তার কক্ষে প্রবেশ করল। তার হাতে একটা চিঠি। চিঠিটা জন হাতে নিয়ে উল্টে-প্লাটে দেখল। চিঠিতে কোনো প্রেরকের নাম লেখা নেই। কিন্তু হাতের লেখা দেখে বুঝতে পারল চিঠিটা তার ছেলের লেখা।
চিঠি পড়ে জনের হতাশা আরও বেড়ে গেল মনে হল। সে অনেকদিন থেকে অবসরের কথা ভাবছিল; কিন্তু পরিস্থিতি মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছে। একজন যোগ্য উত্তরসূরি ছাড়া যার তার কাছে ক্ষমতা যাওয়া মানে দেশের বারোটা বাজানো। তার মনে বড় আশা ছিল ছেলেকে সে দেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করাবে। কিন্তু ছেলের ইচ্ছা দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো। সে আর না করেনি। তবে মনে মনে সে বড্ড হতাশ হয়েছিল। তাদের পরিবারের এতদিনের রাজনৈতিক ইতিহাসের সমাপ্তি তাকেই রচনা করতে হবে মনে হলে খুবই খারাপ লাগে তার। বড়ই ক্লান্ত সে, অথচ তার সামনে রাজ্যের কাজ পড়ে আছে।
চিঠিটা টেবিলে রেখে রিভলভিং চেয়ার ঘুরিয়ে পেছনের জানালার দিকে মুখ করে বসল। বাইরের প্রকৃতিতে শীত তার মনকেও যেন স্পর্শ করল। কোন চিরসবুজ গাছের পাতা আজ আর দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, ক্রান্তীয় পাতাহীন গাছগুলোকে অনেকটা ক্যাকটাসের মতো লাগছে। চারদিকে সাদা তুষার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। সাদা তুষারের দিকে এক দৃষ্টতে তাকিয়ে থাকলে মাথা কেমন ঝিম ঝিম করে, চোখে ক্লান্তি নেমে আসে। শান্ত, নীরব এ প্রকৃতি যেন জনের দীর্ঘজীবনের ক্লান্তিকর মুহূর্তগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। চোখ ফিরিয়ে নিল জন। হেলেপড়া সাদা সূর্যের মতো সেও যেতে চায় শেষ দিগন্তে; কিন্তু অসীম এ সৃষ্টি জগতে সে দিগন্তের দেখা সর্বদা মেলে না। আর যেদিন মেলে সেদিন সবকিছু ছেড়ে পাড়ি দিতে হয় অজানা পথ। মুহূর্তে গা শিউরে উঠল জনের। সে এ পথ পাড়ি দিতে কতটা প্রস্তুত?