অসম্ভবঃ ছয়

জনের নাতিকে ফ্রেড পড়ায় প্রায় চার-পাঁচ মাস হয়ে গেল, অথচ এর মাঝে একদিনও জনের সাথে তার দেখা হয় নি! প্রতিদিনের মতো আজও সে জনের নাতিকে পড়িয়ে বসার ঘরে বসে ছিল। এমন সময় ঘরে প্রবেশ করল জন। জনকে দেখে ফ্রেড উঠে দাঁড়াল। জন বলল, "বস, বস, আমার মতো একজন অধমকে দেখে দাঁড়ানোর কোন মানেই হয় না।" ফ্রেড বসে পড়ল। জন আবার বলল, "তা আমার নাতিকে কেমন দেখলে?" "ভালই। পড়াশুনায় তার বেশ আগ্রহ।" জবাব দিল ফ্রেড।
- "তোমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে? শুনলাম এবার নাকি ছুটিতে বাড়ি যাওনি?"
- "জ্বী, নানা ব্যস্ততার কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।"
- "আচ্ছা, তোমার আর কোনো ভাই-বোন নেই?"
- "না, আমি আমার মায়ের একমাত্র সন্তান।"
- "তোমার মা কি গ্রামেই থাকেন?"
- "জ্বী।"
- "তোমার মা গ্রামে একা কীভাবে থাকেন?"
কথা বলল না ফ্রেড। কিভাবে সে জনকে নিজের মনের কথাগুলো বলবে? জীবনে সে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে আজ এতদূর এসেছে। আর এসময় তার পাশে বন্ধুর মতো পাশে থেকেছে তার মা। সে বাবার মুখ দেখেনি, তার চাচারা ছাড়া আর সবাই তাকে আর তার মাকে পরিত্যাগ করেছিল। কিন্তু তাতেও ফ্রেডের কিছু যায় আসেনি। একজন এতিম ছেলের মা-ই তার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু কে জানত একদিন তাকে তাও হারাতে হবে!
ফ্রেডের নীরবতা ছিল লক্ষ করার মতো। জন বলল, "একটা সময় ছিল যখন আমি প্রতিদিন গ্রামে যেতাম শুধুমাত্র গ্রামের প্রকৃতি দেখার জন্য। এটা নিয়ে আমার ভাইরা আমার সাথে টিটকারি করত। বাবাও আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। বাবার ইচ্ছা, আমি যেন একজন বড় উকিল হই। তিনি বড় ছেলেকে তার মতো পলিটিক্সের সাথে জড়িত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের জোরে আমিই হলাম রাজনীতিবিদ আর সে হলো উকিল। আমি তখনো ভাবিনি জীবনে বড় হয়ে ঠিক কি করব। জীবনের লক্ষ্য বলে যে কিছু আছে, তখন তা মাথাতেই আসত না। যখনই সময় পেতাম গ্রামে যেতাম, আর অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতাম প্রকৃতির দিকে। যখন হাইস্কুলে উঠলাম তখন চারিদিকে হঠাৎ ভাঙনের ধ্বনি শুনতে পেলাম। একে একে সব রাজ্যগুলো ভাগ হতে লাগল। বাবা অনেক চেষ্টা করেও মন্ত্রীসভাকে টিকিয়ে রাখতে পারলেন না, রাজ্যপ্রধানগণ একে একে নিজেদের পদত্যাগপত্র জমা দিতে লাগল অথবা নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কেউ কেউ বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিল। বাবা আমাদের সকলকে গ্রামে রেখে এলেন। আমরা তিনভাই আর মা - বেশ ভালই কাটছিল দিনগুলি। হঠাৎ একদিন গ্রামে আমার এক পরিচিত লোকের কাছে শুনতে পেলাম প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ বিদ্রোহীরা ঘিরে ফেলেছে। আমি দিক-বিদিক হারিয়ে রওয়ানা দিলাম রাজধানীর দিকে, যাবার সময় মা কিংবা ভাইদের বলার সুযোগও পেলাম না। রাজধানীতে গিয়ে শুনতে পেলাম, বাবা আর বেঁচে নেই। বাবাকে শেষ বারের মতোও দেখার সুযোগ পেলাম না। আমি যখন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে গেলাম, তখন মিথুনিয়ার তৎকালীন ও শেষ মেয়র আমাকে তাড়াতাড়ি করে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন যে আমার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে যাওয়া মোটেও নিরাপদ নয়। তারা প্রেসিডেন্টকে মেরেছে, এখন তারা প্রেসিডেন্টের বংশ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার পরিকল্পনা করেছে। আমি তাকে আমার মা ও ভাইদের কথা বললাম। তিনি একজন লোক পাঠিয়ে দিলেন আমার মা ও ভাইদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। তারা আমার মা ও মেজভাইকে মেরে ফেলে। বড় ভাই পালিয়ে যায়। মাকেও শেষবারের জন্য দেখার সৌভাগ্য আমার হয়ে ওঠেনি। বড়ভাইকে প্রায় ১০ বছর ধরে খুঁজে বেড়িয়েছি, পাইনি।" একটা দীর্ঘশ্বাস নিল জন। "এটা আজ হতে প্রায় ৩০ বছর আগের ঘটনা। এই ৩০ বছরে কত পরিবর্তন এসেছে! আগে যে বাবা ছিলেন একজন দেশদ্রোহী, তিনি নিমেষে হয়ে গেলেন শহিদ। আদালত প্রায় জোর করে আমাদের এই পুরনো বাড়িটাতে আমাকে থাকার অনুমতি দিল। মিথুনিয়ার সাবেক মেয়রের অনুপ্রেরণায় আমি রাজনীতিতে প্রবেশ করি এবং আজ অবধি এ পথেই আছি। জীবনটা আসলে অনেক কমসময়ের জন্য। এখন বয়স চল্লিশ পার হয়ে গেলো। আর ক'দিনই বা বাঁচব! কম সময় হলেও বড় বিচিত্র এ জীবন! কত অভিজ্ঞতা, কত আনন্দ, বেদনা, কত পাওয়া, না পাওয়া! কিন্তু এ সবকিছুর পেছনে উদ্দেশ্য কি?" থামল জন।
জন থামলেও ফ্রেড কোন কথা বলল না। কি বলবে সে? বলার তো তার কিছুই নেই। সে এতদিন ভাবত যত দুঃখ-বেদনা সব যেন শুধুই তার। কিন্তু তার এ দাবী যে মোটেও সঠিক নয় তা সে আজ বুঝতে পেল। এ জীবনের কী উদ্দেশ্য? - অন্য সবার মতো তারও মাঝে এ প্রশ্ন খেলা করে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের মত সেও ভুলে যায় কোন জগতে সে বাস করছে।
আজ পিটারসন মেমোরিয়ালের পাশ দিয়ে যাবার সময় ফ্রেড পুলারের লেখা বই "হারানো স্বাধীনতা"র প্রথম খণ্ড কিনে নিয়ে গেল। জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার জন্য বোধ হয় এর চাইতে কোনো ভাল বই এ গ্রহে নেই।