অসম্ভবঃ তিন

দেখতে দেখতে কিভাবে যে একমাস কেটে গেল, ফ্রেড টেরই পেল না। সোমারে এখন বর্ষাকাল। প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হয় এসময়।এমনি এক বর্ষণমুখর সন্ধায় তার বিছানায় বসে পাশের জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছিল। ড্যান তার বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। নাহ, ক্লাসের পড়া নয়। উপন্যাস পড়ছে সে।
সে ড্যানের দিকে তাকাল। বলল, "একটা জিনিস আমার জানা ছিল না।"
-"কি?"
-"রাজনীতিকরাও উপন্যাস পড়ে!"
-"রাজনীতিকরা সব পড়ে। একটা দলকে নেতৃত্ব দিতে চাইলে; একটা দেশ পরিচালনা করতে গেলে শুধু যোগ্যতা থাকলে হয় না অনেক কিছু জানতেও হয়।"
-"এত জেনে কি লাভ হয় বল? একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে তো সবাই দুর্নীতিতে শীর্ষে চলে যায়।"
-"সবাই কি একরকম হয়, বল? কেউ নিজের জ্ঞানকে ভালো কাজে লাগায়, আবার কেউবা খারাপ কাজে - এটাই তো জগতের নিয়ম।"
-"জগতের নিয়ম! জগত নিজে নিজে নিয়ম সৃষ্টি করতে পারে নাকি?"
-"জগত হয়তো পারেনা; কিন্তু স্রষ্টা তো পারেন।"
-"তাহলে এর অর্থ কি এটা হচ্ছেনা যে, স্রষ্টাই আমাদের দিয়ে এসব করাচ্ছেন?"
-"হ্যাঁ, অনেকটা তাই।"
-"কেন তিনি এমন করছেন?"
-"এর সঠিক জবাব আমার কাছে নেই। তাঁর জগত পরিচালনার এ নীতি আমার কাছে বড় অদ্ভুত লাগে।"
-"কারণ তুমি শুরুতেই ভুল করেছ।"
-"কীভাবে?"
-"স্রষ্টা আমাদের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন; এবং তিনিই আমাদের ভালোমন্দ নির্বাচনের সুযোগ দিয়েছেন। কাজেই এটা জগতের কোনো নীতি নয়; এটা আমাদের তৈরী করা নীতি।এবং আমাদের এই নীতি তৈরি করার পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। তবে এর মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে কারণটি তা হলঃ আমরা এই দুর্নীতি, কু-নীতির মাঝে বসবাস করতে করতে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি । আর এই হতাশা থেকে মুক্তি পেতে খোদ এই কাজকর্ম গুলোকেই 'জগতের নিয়ম' বানিয়ে দিয়েছি।"
-"তা ঠিক । কিন্ত সমাজের প্রতিটি শিরায় শিরায় বয়ে চলা এই দুর্নীতি, কু-নীতি থেকে সমাজকে বাঁচানোর এ গুরু দায়িত্ব নেবে কে?"
-"এই সমস্যার মুকাবিলা করা একার পক্ষে অসম্ভব; এজন্য চাই সামষ্টিক উদ্যোগ।"
-"আর এজন্য দরকার একটি আদর্শবাদী সামাজিক-রাজনৈতিক দল, নয় কি?"
-"তুমি ঠিক বলেছ। এ সমস্যা সমাধান করতে চাইলে শুধুমাত্র একটা আদর্শবাদী সামাজিক সংস্থা বা দল যথেষ্ঠ নয়; একটা আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দলও অত্যন্ত জরুরী।"
-"তাহলে সব জেনেশুনেও তুমি রাজনীতি করছ না কেন?"
-"কারণটা এর আগেও অনেকবার বলেছি এবং আজও বলছিঃ আমি নিজেকে রাজনীতিতে জড়াতে চাচ্ছিনা কারণ এ দেশে রাজনৈতিকভাবে আদর্শিক কোনো দল নেই।"
-"কেন? 'জনফ্রন্ট'কে কি তোমার কোনো আদর্শিক দল মনে হয় না?"
-"হ্যাঁ, তারা তাদের দলীয় ব্যাপারে আদর্শিক- কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দলীয় আদর্শ ও রাজনৈতিক আদর্শ মোটেও এক জিনিস নয়।"
-"তাহলে আমরা দেশ পরিচালনা করছি কিভাবে?"
-"দলীয় আদর্শ দিয়ে। একারণেই তো তোমাদের দলীয় লোকজন সব জায়গায় অন্যান্যদের চেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছে, পাচ্ছেনা কি?"
-"মানলাম এদেশে রাজনৈতিকভাবে আদর্শিক কোনো দল নেই। আর এ জন্য তুমি দর্শক হয়ে শুধু বসে বসে দেখবে?"
-"এছাড়া আর কি উপায় আছে বল? আমি একজন সামান্য মানুষ। রাজনৈতিক সংস্কার আমার দ্বারা কি আর সম্ভব?"
-"কেন সম্ভব নয়? চেষ্টা থাকলে সব সম্ভব- এটা তো তুমি রোজই বল।"
-"কিন্তু একটা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা কোনো ছেলে খেলা নয়। যে কেউ চাইলে তা পারে না।"
-"এখানে আবার রাজনৈতিক দল গড়ার কথা কে বলল?"
-"তার মানে তুমি বলতে চাও যে একটা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের মাঝে থেকে সেই দলকে একটি আদর্শবাদী দলে পরিণত করা?"
-"ঠিক তাই।"
-"কিন্তু এটা করতে গেলে এমনও তো হতে পারে যে আমি নিজেই তাদের আদর্শের ফাঁদে পড়ে গেলাম।"
-"তীব্র প্রচেষ্টা আর দৃঢ় ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। ইতিহাস বইয়ে পড়নি পিটারসন একজন এলিয়েন বংশদ্ভুত হয়েও আমাদের কীভাবে সাহায্য করেছিলেন এ গ্রহ থেকে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যে?"
ফ্রেড ড্যানের প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। সে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল জানালার বাইরে। বাইরে এখনও অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে।

অসম্ভবঃ দুই

জীবনের এই চরম মুহুর্তগুলো অনেকবার এসেছে ফ্রেডের জীবনে এবং প্রতিবারই সে টিকে থেকেছে সাফল্যের সাথে, এরই নাম বোধহয় জীবন-যুদ্ধ, ভাবছিল ফ্রেড। তার বাবা বহু আগেই তাদের ত্যাগ করেছে: মার কাছে সে বহুবার একথা শুনেছে, কিন্তু তার বাবা এখন কোথায়, জীবিত কি মৃত - তা কোনোদিনও মা বলেনি তাকে। এসব মনে হলে মায়ের ওপর খুব অভিমান হয় ফ্রেডের। বিশেষত একারণে যে তার মা আরেকটা বিয়ে করেছে সে তার মায়ের পেটে থাকতেই।
ড্যানের ডাকে সে ঘুম থেকে জাগল। ভাবতে ভাবতে আজও সে পড়ার টেবিলে ঘুমিয়ে পড়েছে।
নাহ, ইদানিং যেন পড়াশুনায় আর মনই বসছে না!
"কিরে কি সিদ্ধান্ত নিলি?" জিজ্ঞেস করল ড্যান।
ফ্রেডের মনে পড়ল, জনের দেয়া টিউশনি সে করাবে কিনা তা আজ তাকে জানানোর কথা। ঠিক এ চিন্তাটাই সে করছিল কিন্তু হুট করে সব কেমনজানি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল।
'জীবন-যুদ্ধ', হাসল সে।
-"কি ব্যাপার হাসছিস যে? আমি কি তোকে কোনো হাসির কথা বললাম নাকি?"
ফ্রেড হাসি থামিয়ে ড্যানের দিকে তাকাল। তারপর সে গম্ভিরমুখে বলল, "না, এমনিতেই হাসছিলাম।"
"টিউশনির ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিলি?" পুনরায় জিজ্ঞেস করল ড্যান।
-"সিদ্ধান্ত? সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা যদি আমার থাকত তবে জনের সাথে দেখাই করতাম না। মানুষ যখন বেকায়দায় পড়ে তখন তার 'নিজের সিদ্ধান্ত' বলে আর কিছু থাকে না।"
-"থাকে, থাকে, তুই আসলে নিজেকে বড় অসহায় ভাবিস। দুনিয়ার সব মানুষই জীবনে কোনো না কোনো সময় কঠিন বাস্তবতার সন্মুখীন হয় এবং তারা অধিকাংশই তা জয় করে নেয়। "
-"তুমি তো কোনোদিন এর মাঝে পড়নি, যেদিন পড়বে সেদিন বুঝবে।"
হাসল ড্যান। বলল, "মানুষের লাইফস্টাইল দেখে কি সব কিছু বোঝা যায়?"
একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ড্যান আবার শুরু করল, "যাকগে ওসব কথা। আমি তাহলে জনকে বলে দিই যে তুমি তার প্রস্তাবে রাজী হয়েছ।"
বলেই সে ঘর হতে বেরিয়ে গেল।
ফ্রেড পিটারসন পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে। জনের সাথে তার এখানে দেখা করার কথা। পার্কটা তার কলেজের একদম কাছে। কিন্তু সে একদিনও এখানে আসেনি। পার্কের পাশেই পিটারসন মেমরিয়াল। মেমরিয়ালের দুইটা গেট: একটা বাইরে থেকে, যা কিনা মূল ফটক এবং অপরটি পার্কের মধ্য দিয়ে। পার্কের মধ্য দিয়ে ঢোকার ফটকটির ওপরে পিটারসনের এক বিরাট ছবি।
ফ্রেড ছবিটার দিকে তাকিয়ে হাসছিল।
"তুমি যা ভাবছ মূল ঘটনা আসলে তা ছিল না।" বলতে বলতে জন এসে তার পাশে বসলেন।
-"তাহলে কি ছিল? পিটারসন এলিয়েনদের সাথে যুদ্ধ করেন নি?"
-"করেছিলেন এবং মজার ব্যাপার হলো তিনি নিজেও তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।"
-"এগুলো তো রূপকথা।"
-"তোমার কাছে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক। তুমি তো আর বইয়ের বাইরের ইতিহাস জান না।"
-"কেন? বইগুলোতে কি ভুল কিছু লেখা আছে?"
-"না নেই। তবে ইতিহাসের একটা বৈশিষ্ট্য কি জান? আংশিক ইতিহাস জেনে কোনোকিছুই যাচাই করা যায়না। তুমিও বুঝবে যেদিন আমাদের কাতারে আসবে।" থামল জন। তারপর আবার শুরু করলেন, "যাহোক, এখন কাজের কথায় আসা যাক। তুমি তাহলে আগামীকাল থেকে শুরু করছ।"
-"কিন্তু কাকে পড়াব তা তো এখন পর্যন্ত বলেন নি!"
-"আমার নাতিকে পড়াবে। ড্যান তোমাকে আমার ছেলের বাড়িতে নিয়ে যাবে।" থামল জন। তারপর আবার শুরু করলেন, "ওকে। তাহলে সে কথাই রইল। আমি তাহলে উঠি। জানই তো কত ব্যস্ততার মাঝে থাকতে হয়। মনে রেখ, ইতিহাস হলো এমন একটা জিনিস যা মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর যারা ইতিহাস বিমুখ তারা পেছনেই পড়ে থাকে। এখন হয়তো তুমি তা বুঝবে না। কিন্তু যখন তোমার জীবনের সব স্বপ্ন সত্যি হবে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে সেদিন বুঝবে, জীবনে স্বার্থকতা আসলে কোথায়। অবশ্য তখন সময় আর হয়তো থাকবে না নিজেকে শুধরিয়ে নেয়ার মতো। তবে যারা নিজেকে শুধরিয়ে নিতে পারে তারা হলো বিশ্বের সবচেয়ে সুখি মানুষদের একজন।" বলেই জন উঠে দাঁড়াল এবং দ্রুত পা বাড়াল পিটারসন মেমরিয়ালের ফটকের দিকে। ফ্রেড সেদিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর পার্কের বেঞ্চটার দুদিকে দু হাত প্রসারিত করে তাকিয়ে থাকল আকাশের দিকে।