দেখতে দেখতেই ছুটি ফুরিয়ে এল। এখন গোটা হল আবার ভর্তি। ড্যানও এসেছে;
কিন্তু তার মন খারাপ। ফ্রেড কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে যে তার সমস্যাটা
পারিবারিক। ফ্রেড আর কিছু বলেনি, হতে পারে তার পারিবারিক সমস্যাটা অনেক বড়
এবং তাকে বলার মতো নয়। সে নিজেও তো অনেক পারিবারিক ব্যাপার গোপন করে।
পৃথিবীটাকে
অনেকসময় অনেক ছোট মনে হয় ফ্রেডের কাছে। একসময় সে কত স্বপ্ন দেখত! কিন্তু
আজ নানা ঘটনার ঘনঘটায় এবং বিচিত্র ও নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় সে স্বপ্ন দেখতে
ভুলে গেছে, হারিয়ে ফেলেছে অনুভূতিও। মাঝে মাঝে তার মনে হয় - সে কি আসলেই
একজন মানুষ? যদি সে মানুষ হয়েই থাকে তবে মানুষের সংজ্ঞা কি দাঁড়ায়? আর
মনুষ্যত্ব? সেতো মানুষদের নিজেদেরই তৈরী করা একটা মতবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়।
নাহ, সে তো আর দর্শনের ছাত্র নয়, সে হলো অর্থনীতির ছাত্র, তার এসব জিনিস
মাথায় আসবে না - এটাই তো স্বাভাবিক! তার মনে পড়ে ভার্সিটি জীবনের প্রথম
দিকের দিনগুলির কথা, যখন সে স্বপ্নের মাঝে বিচরণ করতো, একদিন সে বড় হবে,
তার গ্রামের মানুষদের সমালোচনার জবাব দেবে ইত্যাদি, এবং এসব স্বপ্ন দেখতে
দেখতে তার ঘুমিয়ে পড়ার কথা। সত্যি বড় অদ্ভুত এ জীবন! কয়েক মাস আগেও তার
কাছে স্বপ্নগুলো বেশ জীবন্ত মনে হতো, অথচ কয়েক মাসের ব্যবধানে এ স্বপ্নগুলো
তার কাছে অন্তঃসার শূন্য মনে হতে লাগল! জন তাকে একবার বলেছিলেন যে জীবন
নাকি অনেকগুলো পর্যায়ে বিভক্ত এবং প্রতিটি পর্যায়েই মানুষ জীবনকে নতুনভাবে
চিনতে শেখে। হয়তো তার কথা ঠিক, হয়তো সে নতুন কোনো এক পর্যায়ে এসে হাজির
হয়েছে।
ফ্রেড তার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকাল।
প্রকৃতিতে শীতের আমেজ নেমে এসেছে, প্রকৃতি শুভ্র রং ধারণ করতে শুরু করেছে।
তার চোখ এবার চলে গেল আকাশের দিকে। আকাশে আজ একটি মাত্র চাঁদ। চাঁদটি যেন
একাকীত্বের প্রতীক হয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সন্ধা নেমে
আসছে, তারাগুলো চাঁদকে সঙ্গ দেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু চাঁদ তাদের দিকে
তাকায় না, হয়তো এ নিঃসঙ্গতাকে সে ভালোবাসে বলেই এমনটা করে অথবা তার জীবনে
সে একাকী থাকবার সু্যোগ খুব কম পায় বলে আজ একটু একাকী থাকার চেষ্টা করছে।
ফ্রেড চোখ নামিয়ে নিল।
আগামীকাল
জন তাকে ডেকেছে। তবে কারণ উল্লেখ করেনি, সে অবশ্য জিজ্ঞেস করার কৌতুহলও
বোধ করেনি। অদ্ভুত মানুষ এই জন। দেখে কারো মনেই হবে না এই লোকটার ক্ষমতা
কতটুকু হতে পারে।
নাহ, একটু পড়া দরকার, ভাবল সে। টেবিলে উল্টো করে রাখা বইটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করল সে।
বাইরে
চাঁদের আলোয় তুষার কণাগুলো জ্বল জ্বল করছে, আর আকাশের তারাগুলো যেন সেদিকে
তাকিয়ে অবিরত নাচছে। শীতল এ মহাবিশ্বের কলঙ্কস্বরূপ তারাগুলো তুষার খুব
কমই দেখতে পায়।
পরদিন সকালবেলা।
আজ আবার সেই পিটারসন পার্কে
বসে আছে ফ্রেড। এখানেই জনের সাথে তার দেখা হবার কথা। গোটা পার্ক আজ সাদা রং
ধারণ করেছে। শীতকালে সে কখনো খোলা কোনো স্থানে যায়নি, যদিও বা তার বাড়ি
গ্রামে। জীবনে প্রথমবারের মতো নিজেকে তুষার ঢাকা ময়দানের মাঝে আবিস্কার করে
ঠিক কেমন লাগছে, সে বুঝতে পারে না। এখনও শীত তেমন পড়েনি। তাই তুষারের স্তর
খুবই পাতলা, দেখে মনে হয় সবকিছুর ওপর যেন চুনের আস্তরণ পড়ে আছে।
ঠিক
সময়মত এবং পূর্বের মতো ঠিক পশ্চিম দিক দিয়েই এল জন। তার মুখে আজ হাসি নেই।
মুখটি মলিন আর আজকের প্রকৃতির মতোই ফ্যাকাশে। ফ্রেড অভ্যাসমত আজও উঠে
দাঁড়াল। জন হাসি টানার চেষ্টা করে বলল, "বস, বস।"
ফ্রেড বসল। বসল জনও।
একটু পর জন বলল, "আমি আজ তোমাকে এখানে ডেকেছি একটা ব্যক্তিগত কারণে, যা তুমি ছাড়া আর কেউ এমন কি ড্যানও জানবে না।"
ফ্রেড
এতক্ষণ হেলান দিয়ে বসেছিল। জনের কথায় সে একটু নড়েচড়ে বসল। ভাবল, জনের আবার
এমন কি গোপন কথা থাকতে পারে যা কিনা এমনকি ড্যানকেও বলা যাবে না!
জনই আবার মুখ খুলল, "তুমি হয়তো শুনে থাকবে মাস্কারাসদের ধ্বংস করার পর প্রতিটি রাজ্যের সব গভর্নরদের নিয়ে একটি শান্তি বৈঠক করা হয়।"
-"জ্বী। ৩০৪৭ সালের ২৩ আগস্ট।"
-"তা
ঐ বৈঠকে প্রস্তাব করা হয় যে মাস্কারাসদের ব্যবহৃত কোনো অস্ত্র মানুষ
ব্যবহার করবে না; বরং সব অস্ত্র ধ্বংস করে ফেলা হবে। এ বৈঠকে সকলে এ
ব্যাপারে একমত হয় এবং ২ সেপ্টেম্বর সকল অস্ত্র একত্রে জমা করে ধ্বংস করা
হয়। সে হিসেবে আর তো কোনো অস্ত্র থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনদিন আগে আমার
ছেলের কাছ থেকে জানতে পারলাম সব অস্ত্র ধ্বংস করা হয়নি। ঐ সময় ইলি নদীর
ওপারের দুই রাজ্য, আময়ডেন ও এলবানডোর, গোপনে কিছু অস্ত্র তাদের গোপন
অস্ত্রাগারে রেখে দেয়। আজ প্রায় তিনশ বছর পর একটা রিসার্চ টিম পুরনো সামরিক
ঘাঁটি নিয়ে রিসার্চ করার সময় ঐ অস্ত্রগুলো উদ্ধার করে। কিন্তু তারা এটা ওই
দুই রাজ্যের সরকারের নির্দেশে গোপন রেখেছে। ঘটনাক্রমে আমার ছেলে ওই সময়
আময়ডেন-এ ছিল। আময়ডেনের স্বরাষ্টমন্ত্রীর সাথে তার খাতির থাকায় সে এ ঘটনা
জানতে পারে। শুধু তাই না তারা এসব অস্ত্র কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সে
ব্যাপারে তারা আজ দুই বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে বের করেছে। এখন তারা তা সামরিক
কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করছে।"
বলে থামল জন। ফ্রেড বুঝতে পারছে এসব কথা জন কেন তাকে বলছে।
জন
আবার বলা শুরু করল, "তুমি হয়তো মনে করছ, কেন তোমাকে এসব কথা বলছি। তবে
আরেকটু ধৈর্য্য ধরে শোন। তো, আমার ছেলে নাকি এ ঘটনা জানতে পেরেছে অনেক আগে।
কিন্তু বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু দিন কয়েক আগে আময়ডেনের
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসব গোপন কথা অনেকের কাছে ফাঁস করে দেবার অপরাধে
গ্রেফতার হন। জেরাতে তিনি কাকে কাকে এ ঘটনা ফাঁস করেছেন তা বলে দেন এবং এতে
আমার ছেলের নামও আসে। তিনদিন আগে আমার ছেলে আময়ডেনে যেখানে থাকে সেখানে
আময়ডেনের সামরিক বাহিনী গোপনে আমার ছেলেকে গ্রেফতার করতে যায় কিন্তু
ঘটনাক্রমে সেদিন সে সেখানে ছিল না বলে বেঁচে যায়। পরে এ ঘটনা জানতে পেরে সে
আমাকে সবকিছু জানায় এবং আমাকে এবং তার ছেলেকে সাবধানে থাকতে অনুরোধ করে।"
থামল
জন। ফ্রেড তাকে ডাকার উদ্দেশ্য এবার বুঝতে পারল। সে বলল, "তাহলে আপনি
চাচ্ছেন আমি যেন আপনার নাতিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেই, যেখানে তাকে কেউ
চিনবে না।"
-"অনেকটা সেরকমই। তোমার চাচার সাথে এ ব্যাপারে আমার কথা হয়েছে।"
-"কিন্তু এতে তো আমার পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটবে।"
-"না,
তুমি তো আর বেলের সাথে থেকে যাচ্ছ না। তুমি শুধু বেলকে তোমার গ্রামে নিয়ে
গিয়ে তাকে গ্রামের লোকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে যাতে সে ভয় না পায়।"
-"কিন্তু এতে আপনি আমাকে জড়াচ্ছেন কেন?"
-"কারণ
বেল তোমাকে চেনে। তাকে এখন যদি অচেনা কোনো লোকের সাথে থাকতে বলি সে রাজি
হবে না কিংবা জোর করেও যদি থাকতে বলি তাহলে হয়তো সে ভয় পাবে। আর তাছাড়া
নিরাপত্তার কিছু ব্যাপারও আছে। আমি প্রত্যহ যাদের সাথে চলাচল করি এরা সবাই
কমবেশি সুবিধাবাদী। যখন যে সরকার তখন সে সরকারের গোলামী করাই তাদের অভ্যাস।
কাজেই এদের উপর ভরসা করা যায় না। আর বাকী যারা বন্ধু-বান্ধব আছে তাদের
বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়। কারণ সামরিক বাহিনী বেলকে খুঁজতে এলে সবার আগে
তাদের বাড়িতেই খোঁজ নেবে। তাই সবদিক বিবেচনা করে আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তোমাদের বাড়িতে বেল থাকলে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না কিংবা বেলও ভয় পাবে না।"
-"কিন্তু সবাই তো জানে যে আমি আপনার নাতিকে পড়াই।"
-"না,
ড্যান ছাড়া একথা আর কেউ জানে না। একজন নেতাকে নিজের নিরপত্তার জন্য
ব্যক্তিগত জীবনের অনেককিছু গোপন করতে হয়। আমি ড্যানকে বুঝিয়ে বলব যেন সে
একথা কাউকে না বলে। যা হোক, আগেই বলেছি তোমার চাচার সাথে কথা হয়েছে। তিনি
বলেছেন যদি তুমি রাজী থাকো তাহলে তিনিও রাজী। এখন বল তোমার অভিমত কি?"
ফ্রেড ভেবে পায়না কি বলবে। তার সামনে তেমন কোনো বিকল্পও নেই। তবু সে বলল, "এ ব্যাপারে আমাকে ভেবে দেখতে হবে।"
"আমার
হাতে সময় খুবই কম। তবু ভাবনার জন্য তোমাকে একদিন সময় দিলাম। কালকে ঠিক এই
সময়ে এই স্থানে উপস্থিত থেকো।" বলে জন উঠে দাঁড়াল। তারপর ফ্রেডের দিকে
তাকিয়ে বলল, "আমি হয়তো তোমার কাছে একজন খারাপ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কিন্তু
বেল একটা নিষ্পাপ ছেলে। তার সামনে পুরো জীবনটাই পড়ে আছে এবং এ জীবনে তার
নিজের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলবার অধিকারও তার আছে। আশা করি বিষয়টা ভেবে
দেখবে।"
কথা শেষ করে জন তার ডান হাত দিয়ে ফ্রেডের বাম কাঁধ বুলিয়ে যেদিক দিয়ে এসেছিল ঠিক সেদিক দিয়েই গেল। ফ্রেড সেদিকে চেয়ে থাকল।